প্রস্তাবিত গণমাধ্যমকর্মী আইন সাংবাদিকদের জন্য ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’



লিখেছেনঃ মিজানুর রহমান মাসুদ


বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবি ‘গণমাধ্যম/সংবাদমাধ্যম আইন’ আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। আইনটি নিয়ে সাংবাদিক মহলে ব্যাপক আগ্রহ ও কৌতুহলের সৃষ্টি করেছে। দিন গড়িয়ে যাবার সাথে বহুল কাঙ্খিত আইনটি নিয়ে নানা ধরণের তথ্য বেরিয়ে আসছে। আসলে প্রস্তাবিত ‘গণমাধ্যমকর্মী আইন-২০২২’ কতোটা সাংবাদিকদের স্বার্থে প্রণয়ন করা হচ্ছে তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলছে।

এক কথায় বলতে গেলে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে প্রস্তাবিত ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকুরীর শর্তাবলী) আইন-২০২২’ সাংবাদিকদের জন্য ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’। প্রস্তাবিত আইনটি জাতীয় সংসদের উত্থাপনের আগে এ আইনের সংশোধনের দাবিতে সাংবাদিক সমাজ মাঠে নামছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৭ ফেব্রুয়ারি রোববার ‘জাস্টিস ফর জার্নালিস্ট’ শীর্ষক সাংবাদিক সংগঠনের উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছে। এদিন সকাল ১১টায় ‘জাস্টিস ফর জার্নালিস্ট’ এর উদ্যোগে সাংবাদিক সমাজ আইনটির সংশোধনের দাবিতে মানববন্ধন করবে; সাংবাদিক সমাজ তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি উপস্থাপন করবে।

প্রস্তাবিত ‘গণমাধ্যম আইন সাংবাদিকদের জন্য কতটুকু ইতিবাচক জানার চেষ্টা করি। এটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত সাংবাদিকদের জন্য আরেকটি সর্বনাশ উকি দিচ্ছে নাতো ? সেই প্রশ্ন এখন সাংবাদিক মহলের। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য ‘গণমাধ্যমকর্মী আইন ২০২২’ জাতীয় সংসদের উত্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রস্তাবিত আইনটি জাতীয় সংসদে উপস্থাপন পরবর্তী বিল আকারে পাস হলে সাংবাদিক সমাজে মহাসঙ্কটের সৃষ্টি হবে। প্রস্তাবিত গণমাধ্যম আইনে সবমিলিয়ে নতুন ৫৭টি ধারা সংযুক্ত হয়েছে তার মধ্যে ৩৭টি ধারা সাংবাদিকদের পেশাগত মান মর্যাদা ক্ষুন্ন ও স্বার্থ পরিপন্থি বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

আইনের খসড়াটির উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ তুলে ধরা হলো:

(১) প্রস্তাবিত গণমাধ্যম আইনে সাংবাদিকদের বিদ্যমান বা চলমান শ্রম আইনের সকল ধারা বাতিল করায় সুবিধা বঞ্চিত সাংবাদিকরা ন্যায় বিচার পেতে শ্রম আদালতের শরনাপন্ন হতে পারবেন না।

(২) যেহেতু ফৌজদারি বা দেওয়ানী আদালতে সাংবাদিকদের চাকুরি, পাওনা সংক্রান্ত কোন আইন নেই হেতু ফৌজদারি ও দেওয়ানী আদালতেও সাংবাদিকদের ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনো পথ খোলা থাকবে না।

(৩) প্রস্তাবিত আইনে সাংবাদিকদের বিচারিক কোন আদালত থাকছে না; তার উপর বেতন, গ্রেচ্যুয়িইটি বা যে কোন বিরোধ বিষয়ে ন্যায় বিচার পেতে আদালতে যেতে হলে সরকার কতৃক বোর্ডের অনুমতি নিতে হবে।

(৪) প্রস্তাবিত আইনে সাংবাদিকদের জন্য বিদ্যমান শ্রম আইনের বিধিগুলো বাতিল করে সাংবাদিকদের সাংবাদিক কল্যাণ সমিতি করতে বলা হয়েছে; সেহেতু খসড়া আইনটি জাতীয় সংসদে পাশ হওয়ার পর থেকে সাংবাদিকদের জন্য বার্গেনিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করা ইউনিয়নগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

(৫) সম্প্রচার মাধ্যম সংবাদ বিভাগে কর্মরত ক্যামেরাপারসন বা ফটোসাংবাদিক বা চিত্র সাংবাদিকদের পদে সাংবাদিক হতে পরিবর্তন করে কলাকুশলী করা হয়েছে।

(৬) সাংবাদিকদের বিদ্যমান শ্রম আইনে ৬০ বছরে অবসরে যাওয়ার বিধি থাকলেও প্রস্তাবিত আইনে ৫৯ বছরে সাংবাদিকতা পেশায় অবসরে যাওয়ার বিধান করা হয়েছে।

(৭) সাংবাদিকদের বিদ্যমান শ্রম আইনে সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্টদের সপ্তাহে ৩৬ ঘন্টা কর্মকালীন সময় থাকলেও প্রস্তাবিত আইনে ৪২ ঘন্টা প্রস্তাব করা হয়েছে।

(৮) সরকারী এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি ২ দিন। সাংবাদিকদের ২ দিন ছুটির দাবী থাকলেও প্রস্তাবিত আইনে ১ দিন করা হয়েছে এবং সাংবাদিকদের বিদ্যমান শ্রম আইনে সকল সুযোগ সুবিধা কাঁটছাট করে প্রস্তাবিত আইন তৈরী করা হয়েছে।

কর্মরত সাংবাদিকদের সর্বস্তরে পেনশন,ওয়েজবোর্ড রোয়েদাদ মহার্ঘ্য ভাতাসহ মৌলিক দাবি ছিল।দেশের চলমান ও বিদ্যমান আইনে সংস্করন,পরিবর্তন/পরিমার্জন করে সাংবাদিক সমাজের জন্য আরও  উন্নত ও টেকসই আইন প্রণয়ন দরকার।

সাংবাদিকদের বিদ্যমান আইনের সাথে মিল রেখে টিভি ও আনলাইনে কর্মরত সাংবাদিদের জন্য ব্রডকাষ্ট আইন করাসহ সাংবাদিকদের পেশা, সম্মান, স্ট্যাটাস উন্নয়নে প্রেসকাউন্সিল আইন সংশোধন জরুরি থাকলেও সেটা না করে সাংবাদিকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে গণমাধ্যমকর্মী আইন (চাকুরীর শর্তাবলী-২০২২) করার উদ্যোগ আমাদের সাংবাদিক সমাজকে শঙ্কিত করে তুলেছে। চলমান এ সংকটে সাংবাদিক সমাজ কিভাবে পরিত্রাণ পেতে পারে বা এই সংকট দূর করা যায় সেজন্য সকলের অংশগ্রহণে পরামর্শমূলক একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরী। দেশে বিদ্যমান সকল সাংবাদিক সংগঠনকে এ ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে।

লেখকঃ মিজানুর রহমান মাসুদ
যুগ্ন সম্পাদক, আজকের বিজনেস বাংলাদেশ, ঢাকা       

*

إرسال تعليق (0)
أحدث أقدم