আমির হোসেন,সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি:
সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলা সীমান্তে শনিবার থেকে শুরু হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন পণাণতীর্থ (মহাবারুণী স্নান ও শাহ্ আরেফিন(র.) ওরস মাহফিল। ৭’শ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঐতিহ্যবাহী এ দুটি অনুষ্টান ঘিরে সনাতন ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীর কয়েক লাখ ভক্ত-আশেকান, দশনার্থী ও পূণার্তীর সমাগম ঘটে অদ্বৈত্য আর্চা মহাপ্রভুর রাজারগাঁও নবগ্রাম আখড়াবাড়ী সংলগ্ন ২৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সীমান্ত নদী যাদুকাটার দুই তীরবর্তী পণাতীর্থ ধামে ও হযরত শাহ আরেফিন (রাঃ) মোকাম সীমান্তবর্তী লাউড়েগড় এলাকায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানাযায়, আজ শুক্রবার থেকে তিনদিন ব্যাপী লাউড়েরগড় এলাকায় শাহ আরেফিন (রা:) এর মোকামে অনুষ্টিত হবে বার্ষিক ওরস মোবারক। পরের দিন শনিবার থেকে যাদুকাটা নদী সংলগ্ন রাজারগাঁও এলাকায় মহাবিষ্ণুর অবতার অদ্বৈত জন্মধামে পণাতীর্থ মহাবারুণী স্নান ও মেলা বসবে। দুই ধর্মের এই দুটি উৎসবকে ঘিরে সপ্তাহখানেক পূর্ব থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা ভক্ত-আশেকানদের আগমনে পুরো এলাকা সম্প্রীতির এক মেলবন্ধনে পরিণত হয়। দুই ধর্মের ভক্ত আশেকান ও পূর্ণাতীরা গান বাজনা আর আরতিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেতে উঠে রাতদিন।
তবে এ বছর পবিত্র রমজান মাস থাকায় শাহ আরেফিন মোকামে কাফেলাগুলোতে মাইক, সাউন্ড সিস্টেম ও গান-বাজনাতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এছাড়াও রমজানের পবিত্রতা বজায় রেখে অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এদিকে পণাতীর্থ গঙ্গাস্নান ও ওরস উদযাপন উপলক্ষে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন, তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা প্রশাসন অনুষ্ঠান দুটির উদযাপন কমিটির নেতাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা ও উদযাপনের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে একাধিক বৈঠকও করেছে। সভায় আগত পুণ্যার্থী ও ভক্ত-আশেকানদের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত, উৎসবস্থল ঘিরে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিং, যানবাহন ভাড়া ও যাতায়াত ব্যবস্থা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শাহ আরেফিন (রা:) মোকাম ও পণার্তীথ ধামে আসা যাওয়ার জন্য পূণ্যার্থী ও দর্শনার্থীদের জন্য ওয়াইন বাই রাস্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সুনামগঞ্জ আব্দুর জহুর সেতু থেকে দুই উৎসবস্থল পর্যন্ত পুরো রাস্তায় সার্বক্ষণিক পুলিশের টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এবছর মহাবারুণী স্নান ও মেলার মুখ্য সময় ২৩ চৈত্র ১৪৩০ বাংলা, ৬ এপ্রিল শনিবার দিবা ঘঃ সকল ৭ টা ৫২ মিনিট ১৬ সেকেন্ড গতে রাত ৫ টা ২৮ মিনিট ২৯ সেকেন্ড মধ্যে মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী সকাল ৭ টা ৫২ মিনিট ১৬ সেকেন্ড গতে দুপুর ১ টা ৪৯ মিনিট ১৪ সেকেন্ড এর মধ্যে। এবং মহাবারুণী শতভিষা নক্ষত্র দিবা ১ টা ৪৯ মিনিট ২৪ সেকেন্ড পর্যন্ত।
ঐতিহাসিকদের মতে, অতীতের পাপ মোছন, ঈশ্বরের আশীর্বাদ ও পুণ্য লাভের আশায় প্রতি বছর চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে দেশ ও দেশের বাহিরের কয়েক লাখ সনাতন ধর্মের অনুসারী নর-নারী শ্রী অদ্বৈত আচার্য ঠাকুরের আবির্ভাবস্থল পণতীর্থ স্মৃতিধাম যাদুকাটা নদীর জলে পূণ্যস্নান করে কলুষমুক্ত হন এবং ঈশ্বরের কৃপা লাভ করেন। তাঁদের বিশ্বাস, পণাতীর্থ স্নানের মাধ্যমে মনো-বাসনা পূর্ণ হয়। এ উপলক্ষে মহা-বারুনী মেলা বসে। ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে এই তীর্থের সূচনা করেন মহাপুরুষ শ্রী অদ্বৈত আচার্য ঠাকুর। তার মায়ের স্বপ্নের ইচ্ছানুসারেই অদ্বৈত মাতৃবাক্য পূরণের জন্য তার অলৌকিক মতাবলে পৃথিবীর সপ্তবারির জল একত্রিত করে তার মনোবাসনা পূরণ করেন। এর পর থেকেই হিন্দুধর্মের লোকজন স্নান করতে আসছেন,এই জলধারাই পুরনো রেনুকা নদী বর্তমানে যা যাদুকাটা নদী নামে প্রবাহিত। তাহিরপুর থানার এই নদীর তীরে পনাতীর্থে প্রতি বৎসর চৈত্র মাসে বারুনী মেলা হয়। এ তিথিতে স্নানের পাশাপাশি অনেকে এখানে আসেন মা বাবা আত্মীয় স্বজনের অস্থি বিসর্জন দিতে। প্রতি বৎসর লাখো হিন্দু পুন্নার্থীর সমাবেশ ঘটে এই বারুণী মেলায়। অনেক মুসলমানও এই মেলা দেখার জন্য পনাতীর্থ আসেন। এই সময় সনাতন ধর্মের লোকজন তীর্থরূপি যাদুকাটায় স্নান করার আশায় এসে জড়ো হন নদীতীরের অদ্বৈত মহাপ্রভু চৈতন্যের নবগ্রামে। মন্ত্র পাঠ করে প্রতি বছর চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে সনাতনী সম্প্রদায়ের পুণ্যার্থী নরনারী পাপমুক্তির প্রত্যাশায় সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার অদ্বৈত্য আর্চা মহাপ্রভুর রাজারগাঁও নবগ্রাম আখড়াবাড়ী সংলগ্ন ২৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সীমান্ত নদী যাদুকাটার তীরবর্তী পণাতীর্থ ধামে সেই থেকেই শুধু হয় প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্নান যাত্রার। এবং তাঁর স্মৃতিতার্থে অদ্বৈত আচার্য মন্দির গড়ে উঠেছে যাদুকাটা নদীর তীরবর্তী রাজারগাঁও গ্রামে।
এদিকে প্রতি বছর পণতীর্থ মহা-বারুনী গঙ্গাস্নানের তারিখের সাথে মিল রেখে উপজেলার সীমান্তবর্তী লাউড়েরগড় এলাকায় হযরত শাহজালাল (র.) এর ৩৬০ আউলিয়া অন্যতম সঙ্গী হযরত শাহ আরেফিন (র.) এর বার্ষিক ওরস মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ওরস উপলক্ষে সেখানেও মেলা বসে। স্থানীয়দের মতে, হযরত শাহ আরেফিন (র.) এর মোকাম ভারত সীমান্তের ওপারে এক পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত হলেও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অগণিত মুসলমান নর-নারী ওরসে শরিক হন এবং দূর থেকেই এই দরবেশের মোকাম জিয়ারত করেন। ওরসে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন ছাড়াও হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, পাহাড়ি ও বাঙালি ভক্ত-আশেকান তাঁর স্মৃতিবিজড়িত লাউড়েরগড় এলাকায় সমবেত হন।
শ্রী অদ্বৈত জন্মধাম কেন্দ্রীয় কমিটির তাহিরপুর উপজেলা কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য গণেশ তালুকদার বলেন, গঙ্গাস্নান ও মহা-বারুনী মেলা শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। স্নান ও মেলা শেষে পুণ্যার্থীরা যেন নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারেন এ বিষয়টি এবারও সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
শাহ্ আরেফিন(র.) ওরস উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব আলম সাব্বির বলেন, শাহ্ আরেফিন(র.) ওরস ও মেলা সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপন করতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয়দের সাথে মতবিনিময় হয়েছে।