আমিনুল হক সিপন
ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে নীরু গ্রামের সরু পথ দিয়ে হাঁটছে। কোনো জনমানব নেই রাস্তায়। সবকিছু স্তব্দ। এই মুহূর্তে তার মাথায় একটি বিশেষ নেশা খেলা করছে।
রাত যত বাড়তে থাকে- নীরুর আকাঙ্ক্ষা তত বাড়তে থাকে। এটা নিরুর পুরনো অভ্যাস। এমন তাড়নায় কখনো কখনো অন্য গ্রামেও ছুঁটে চলে। গভীর রাতে সে গ্রামের গ্রামের বাড়ি বাড়ি ছুঁটে গিয়ে লোকজনের ঘরের পেছনের দরজা জানালায় উঁকিঝুঁকি দেয়। কারো গোঙ্গানি, কারো কাশির শব্দ শুনে সে অন্য পথে রওনা দেয়। এমন রাতের নেশায় নীরু অনেক গুলো তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।প্রতি রাতের মতো সেদিন রাতেও ছুঁটতে ছুঁটতে সে গায়ের কুদ্দুস মেম্বারের ঘরের পেছনে উঁকি দেওয়ার সাহস সঞ্চয় করে। দেখলো সবকিছু নিস্তব্ধ। কোনো লোকের সাড়াশব্দ নেই। এবার নিরু হাতের ছাবল দিয়ে ঘরের নীচের সুরঙ্গ খুঁড়তে থাকে।
ঘন্টারখানেক সময় পর তার সিদ্ধি পূর্ণ হলে কুদ্দুস মেম্বারের রান্নাঘরে প্রবেশ করে।
নীরু পুরো ঘরজুড়ে পায়চারি করছে। ছেলেপিলেরা সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন।
কুদ্দুস মেম্বারের শোবার ঘরে ডুকতে আধো আলো, আধো অন্ধকারে দেখতে পায় কুদ্দুস ও তার স্ত্রী একে অপরের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। অর্ধ বয়সী রূপবতী মহিলাটির কাপড়চোপড় অনেকটা অগোছালো।
কুদ্দুস মেম্বারের বালিশের পাশে মানি ব্যাগ। নীরু কোনো লোভ সামলাতে পারছেনা। মানি ব্যাগে হাজার দশেক টাকা হবে। নীরু সবগুলো টাকা পকেটে ভরে নেয়।
অতঃপর বিশেষ লোভে কাতর হয়ে কুদ্দস মেম্বারের রূপবতী স্ত্রীর দিকে তার চোখ যায়। তবুও নিরুপায়। নীরু মেম্বারের স্ত্রীর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রূপ-জৌলুস দেখতে দেখতে ভেতরটা মুচড়ে ওঠে।
গভীর ঘুমে মগ্ন নারীর মুখটা আলতো করে বুলাতে থাকে।
কিন্তু ততক্ষণে আনাড়ি মহিলাটি ভূত ভূত বলে চিৎকার দিয়ে উঠে।
স্ত্রীর চিৎকারে কুদ্দুসের ঘুম ভাঙে। ততক্ষণে আলো-অন্ধকারে দেখতে পায় একটি লোক সজোরে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।
কুদ্দস মেম্বার চুর চুর বলে হাঁক দিলে পাঁড়ার লোকগুলির ঘুম ভাঙে।
চতুর্দিকের লোকজন চুর চুর বলে দৌঁড়াতে থাকে। কোন চুর কোন দিকে যাচ্ছে, সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। তবুও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে লোকজন দৌঁড়াচ্ছে। নিরুর কোনো উপায় নেই।
বাধ্য হয়ে সে-ও চুর চুর বলে চিৎকার করতে থাকে। নীরুর এমন বুদ্ধির কাছে হার মেনে গ্রামের লোকগুলির কাছে চুর অদৃশ্য হয়ে যায়। বহুদিন আগে নিরু এমন জ্ঞান রপ্ত করেছে কুখ্যাত নিধু চোরের কাছ থেকে।
দশ হাজার টাকা কামাই করায় নীরু খুব উৎফুল্ল। বাড়িতে গিয়ে বালিশের নীচে টাকা গুলো রেখে স্বস্তির ঘুম দেয়। পরদিন বিকেলে ধুমধাম করে বাজার করে। স্ত্রীর জন্য লাল শাড়ি কিনে।
এত গুলো বাজার ও শাড়ি দেখে স্ত্রী চম্পার ভ্রু কুঁচকে ওঠে। সজোরে হাঁক দিয়ে নীরুকে বলে, "কার ঘরে ডাকাতি করলি।"
নীরু স্ত্রীর মুখে চাপ দিয়ে বলে- "চুপ চুপ, এই দেখ- কত সুন্দর লাল শাড়ি, তোমার জন্য এনেছি।"
মুখের চাপ ছাড়তেই স্ত্রী চম্পা আবারও বলে, "রাখ তোর শাড়ি, তুই চোর- মহাচোর।"
ততক্ষণে নীরু স্ত্রী চম্পার মুখে সজোরে চাপ দিয়ে ধরে বলে, "চুপ চুপ চুপ চুপ।"
নীরুর ধুমধাম করে কয়েকটা দিন ভালোই চলে। এখন আর তেমন টাকা নেই। ভাবলো এবার পাশের গ্রামে গিয়ে কামাই করতে হবে।
গভীর রাতে রওনা দেয়। কোনো সড়ক দিয়ে না হেঁটে গ্রামের ফাঁকা জমি দিয়ে হাঁটছে। অন্ধকার নিস্তব্ধ রাতে মনে একটি ভয় কাজ করছিল। কিন্তু পাশের গ্রামের সড়কের দ্বারে যেহেতু ভয়ঙ্কর একটা কিছু দেখতে পায়। যেন মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত লম্বা একটা কিছু নীরুকে বলছে "কী রে নীরু কই যাস?"
নীরু হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বলতে থাকে- "আমি চুরি করতে যাচ্ছি।"
ওপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন আসে "তুই চোর?"
ততক্ষণে নীরুর হুশ ফিরলে দেখতে পায় গায়ের পাহারাদার তার সামনে।
পাহারাদার বলে, "কী রে কিছু বলছিস না যে?"
হঠাৎ করে জব্বারকে দেখে নীরু পাল্টা জবাব দেয় "জব্বার ভাই তুমি?"
কিন্তু লোকটা বলে, তুই না বললে, "চুরি করতে যাচ্ছিস?"
নীরু বলে, "ভুল শুনছেন জব্বার ভাই। আমি বিশাল লম্বা একটি ভূত দেখেছি, সম্ভবত ভূত বলেছে।"
জব্বার মুচকি হাসি দিয়ে বলে, "ওহ তাই, তাহলে তুই এখানে কেন?"
নীরু বলে, "গরুটা খুঁজে পাচ্ছিনা, তা-ই খুঁজতে এসেছি।"
"তাহলে খুঁজতে থাক"- বলে পাহারাদার জব্বার চলে গেলে নীরু ভাবলো, না এখানকার আশেপাশে আর চুরি করা যাবেনা,করলেও জব্বার পাহারাদার আমাকে সন্দেহ করবে।
নীরু অনেকক্ষণ হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে একটি গ্রামে গিয়ে দাঁড় হয়। কিন্তু গ্রামের ঘরগুলোতে শোনা যায়, কারো কাশির শব্দ,কেউ মোবাইল দিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে, কোথাও স্বামী স্ত্রীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের শব্দ।
কোথাও স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের শব্দ শুনলে নিরু ভাবতে থাকে রোমান্টিক কতগুলো আচরণ । মনে মনে বলে, ইসরে, উনাদের কত আনন্দের মুহূর্ত কাটে, আর আমার বউটারে রাতে একাএকা ঘরে রেখে অলিতে-গলিতে বিচরণ করি,এটাই বুঝি আমার ভাগ্য।
ভাবতে ভাবতে নীরু নিরাপদ ঘরের সন্ধানে ছুঁটতে থাকে। অতঃপর একটি দালান ঘরের পাশে গিয়ে শুনতে পায় চারিদিকে সুনসান নীরবতা।
তবে গভীর ঘুমে মগ্ন একটি লোকের নাক ডাকার শব্দ কর্ণগোচর হয়। তবুও তার জন্য এ বাড়ি নিরাপদ।
নীরুর অতিরিক্ত নিরাপদের জন্য লুঙ্গীর গোঞ্জা থেকে সরিষার তেলের শিশিবোতল বের করে সারা গা জুড়ে মাখতে থাকে।
কিন্তু ঘরে ডুকবে কী করে? হাতিয়ার তো ভূতের ভয়ে ফেলে এসেছে।
নীরুর মাথায় কিছুতেই ধরছেনা। তাই চারিদিকে উঁকিঝুঁকি বায়। কিন্তু ঘরের সদর দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই দরজাটি খুলে যায়।
দরজা খুলতেই নিরু দেখতে পায় বিশালদেহী লোক নাক ডেকে ডেকে শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন। বালিশের পাশে ঘরের সব চাবি। সম্ভবত স্ত্রী-সন্তানেরা বাড়িতে নেই।
নীরু চাবিগুলো নিয়ে একএক করে সোকেছ, ওয়ারড্রব, আলমারি খুলতে থাকে। নিরু আলমারির ভেতরে দেখতে পায় অনেক গুলি টাকা। সম্ভবত লোকটি খুব মালদার লোক। তাই একটা বস্তার মধ্যে টাকার বান্ডিল গুলো ভরে নেয়।
এ সময় লোকটির বায়ুর বিশাল বড় শব্দ শুনে নিরুর মুখ দিয়ে সজোরে হাসি চলে আসে।
ততক্ষণে লোকটির ঘুম ভেঙে নিরুকে ঝাপটে ধরে। কিন্তু নীরুর তৈলাক্ত দেহে টানাহেঁচড়া করে করে লোকটি টিকে থাকতে পারছেনা। তবুও লোকটি নাছোড়বান্দা। লোকটির সাথে যুদ্ধ করতে করতে নিরু দৌঁড় দিয়ে খেটে পড়ে। লোকটি পেছন থেকে চুর চুর বলে চিৎকার করছিল।
নীরু পেছন থেকে শুনতে পায় লোকটি পেছন থেকে বলছে,তোর ভালো হবেনা রে, এগুলো আমার সারাজীবনের সম্বল।
কিন্তু নিরু হাঁপাতে হাঁপাতে দৌঁড়ে বহুদূর চলে আসে।
পালানোর সময় পথে পাহারাদার জব্বার নিরুকে "দাঁড়া দাঁড়া"- বলে আটকে দেয়।
অতঃপর জব্বার বলে, "ভাগ দিয়ে যা, আর তোর হাতিয়ার নে।"
নিরু মনে মনে ভাবলো- "এই হালা জানলো কী করে, আমার চেয়ে তো আর খারাপ।"
তবু ও নীরু বলে "কীসের ভাগ?"
জব্বার বলে, "চুরির ভাগ। তুইতো নিজে বললি, চুরি করতে যাচ্ছিস। এই যে তোর হাতিয়ার গুলো স্বাক্ষী, ভয় পেয়ে ফাঁকা জমিনে ফেলে দিয়েছিলে।''
নীরু, "না না আমি চোর না।"
জব্বার, "মিথ্যে বলিস না। তোর মতো বহু চুর দেখেছি। অনেক ভাগ নিয়েছি। তাই কিছু পাওনের আশায় এতক্ষণ তোকে সেইভ করার জন্য পাহাড়া দিচ্ছি, দে দে ভাগ দে।"
এ সময় জব্বার নিরুর ব্যাগটি ঝাপটে ধরে খুলতেই দেখে টাকা আর টাকা।
জব্বার দিশেহারা হয়ে বলে- "চুরি করলি তুই, ধনী করলি আমায়।"
অতঃপর অর্ধেক টাকা নিরুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়।
নীরুর বিমর্ষ মুখে আওয়াজ আসে "এ টাকা আমার।"
জব্বার, "টাকা তোর প্রমাণ কী, তোর নাম আছে? বেশি কথা বললো, সবাইকে বলে দিবো।"
কথা শুনে নীরুর মুখ চুপ। তাই অর্ধেক
টাকা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
জব্বারের ব্যবহারে নীরু কষ্ট পেলে টাকাগুলো পেয়ে খুশি। এ দিয়ে সারাজীবন সে বসে বসে খেতে পারবে। আর চুরিচামারি করতে হবেনা।
নীরু বাড়িতে গিয়ে টাকা গুলো বিছানার নীচে রেখে মনের সুখে ঘুম দেয়। কত সুখের স্বপ্ন দেখে। ছেলেপুলে হবে। তারা মানুষের মতো মতো মানুষ হবে। নীরুর মতো চোর হবেনা। কত ভাবনা। এসব ভাবতে ভাবতে একসময় নীরু ঘুমিয়ে পড়ে।
দুপুরে ঘুম থেকে উঠে বিছানা তুলতেই নিরু হতবাক। কোনো টাকা নেই।
গতরাত স্বপ্ন দেখলো নাকি সত্যি নিরু বুঝে উঠতে পারছেনা। না স্বপ্ন নয় সত্যি। তাই নীরু হন্য হয়ে ঘরের চারিদিকে টাকা খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও নেই।
স্ত্রী চম্পা ঘরে ডুকলে নীরু বলে, "কিছু পেয়েছো?"
চম্পা, কী?
নীরু বলে, টাকা।
প্রতিত্তুরে চম্পা, "টাকাগুলো মেম্বারের হাতে দিয়ে এসেছি, যার টাকা তাকে ফেরত দেওয়া হবে। আর চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে তোমার বিরুদ্ধে সালিশ বৈঠক হবে।"
নীরু বলে, "সর্বনাশ এ তুই কী করলি? আমার সব শেষ।"
চম্পা- "হ্যাঁ করেছি, তুমি ভালো হওয়ার জন্য করেছি।"
নীরুর মাথায় রক্ত ওঠে। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে হাতের দ্বারে থাকা বটি দা দিয়ে স্ত্রী চম্পার গলায় সজোরে এক কুপ দেয়।
সাথে সাথে মাথা দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায়।
প্রিয়তমা স্ত্রীর দু' ভাগ দেহ আর রক্ত দেখে নীরু বিলাপ করতে থাকে।